যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছে ১৯৬৮ সালের ছাত্র আন্দোলন

যুদ্ধবিরোধী শিক্ষার্থীদের দমন করতে পারছে না প্রশাসন

Daily Inqilab ডানা ইশরাত

২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৭ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে ১৯৬৮ সালের ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশন (ডিএনসি)-তে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন বিরোধী বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ যেটিতে আমেরিকানরা প্রথম টেলিভিশনের মাধ্যমে যুদ্ধের ভয়াবহতা অবলোকন করেছিল।

ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের বেশিরভাগই মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্যাম্পাসে গতি পেয়েছিল এবং চরম রূপ ধারণ করেছিল। এবার যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইসরাইল দ্বারা ফিলিস্তিনে আগ্রাসন ও গণগত্যার বিভীষিকার মধ্যে সেই আন্দোলনের জোয়ার আবারও ফিরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে।

গত ছয় মাস ধরে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে, যাতে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে যুদ্ধবিরতি এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আক্রমণ থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিচ্ছিন্ন করার আহŸান জানানো হয়। যদিও মার্কিন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলি কঠোরভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, কিন্তু তরুণরা বিশেষ করে, সামাজিক মাধ্যমগুলিতে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধর ভয়াবহ ফলাফলগুলি দেখছে এবং আতঙ্ক অনুভব করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে মর্যাদাপ‚র্ণ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ‹ফিলিস্তিনকে মুক্ত কর›, ‘তোমরা শিশু হত্যাকরী’ সেøাগান দিচ্ছে এবং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে শত শত ছাত্র কয়েকদিন ধরে ক্যাম্পাসের প্রধান চত্বর দখল করে রয়েছে।

মার্কিন তরুণ সমাজ তাদের জীবনের পটভ‚মি হিসাবে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’, ‘বø্যাক লাইভস ম্যাটার’, দ্য পার্কল্যান্ড, ফ্লা, ছাত্রদের বন্দুক নিয়ন্ত্রণ-এর মতো প্রতিবাদী আন্দোলন অবলোকন করে বেড়ে উঠেছে। তাই, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে যখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে, তখন অ-ছাত্র ফিলিস্তিন-পন্থী তরুণ বিক্ষোভকারীরা তাদের প্রতি একাত্মতা দেখিয়ে প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানটির গেটের বাইরে জড়ো হচ্ছে।

দাঙ্গা পুলিশ সোমবার ইয়েলে ৬০ জনেরও বেশি লোককে এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাউনটাউন ম্যানহাটনে ১শ’ ৫০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করেছে। গত সপ্তাহে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রিপাবলিকান প্রতিনিধি ইলহান ওমরের মেয়ে ইসরা হিরসি সহ ১শ’ ৮ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীর গ্রেপ্তার ‘গাজা সলিডারিটি এনক্যাম্পমেন্ট’-এর বিক্ষোভকারীদের আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে, যারা স্পষ্ট করেছে যে তারা নড়বে না।

এই গ্রেফতারিতে সংহতি জানিয়ে যুদ্ধ বিরোধী এই আন্দোলনে আরও যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে পশ্চিমে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সারা দেশে একই ধরনের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বার্কলে এবং ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের কারণে গেল বুধবার শেষের দিকে তার গেটগুলি বন্ধ করে দিয়েছে।

ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে কমপক্ষে ৪৭ জন প্যালেস্টাইনপন্থী বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের সাথে যুক্ত যেকোন আর্থিক স্বার্থ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচ্ছিন্ন করার দাবি করেছে এবং প্রশাসকরা বিক্ষোভের সাথে জড়িতদের সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দিয়েছে।

দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদর বলছে যে, বুধবার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্তত চার ফিলিস্তিনিপন্থী বিক্ষোভকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি অফ প্রোভিডেন্স বুধবার সতর্ক করে দিয়েছে যে, ৯০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ক্যাম্প করে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনের অংশগ্রহনকারী মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি ছাত্র অ্যালেক্স, যিনি প্রতিশোধের ভয়ে শুধুমাত্র তার প্রথম নাম ব্যবহার করেছেন, এনবিসি নিউজকে বলেছেন, ‹এটি সংহতির প্রকাশ। সারা দেশে আমাদের কলেজগুলি একযোগে পদক্ষেপ নিচ্ছে, কারণ আমরা একসাথে কাজ করি। এটি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে একটি সম্মিলিত আন্দোলন।’

যুদ্ধবিরোধী দলগুলি ইতিমধ্যে সম্মেলনে বড় প্রতিবাদের পরিকল্পনা করছে। মার্কিন প্যালেস্টাইন কমিউনিটি নেটওয়ার্কের হাতেম আবুদায়েহ সম্প্রতি শিকাগো ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘আমরা অনুমতি নিয়ে বা ছাড়াই মিছিল করব। এই ডিএনসি ১৯৬৮ সালের পর থেকে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপ‚র্ণ, শিকাগোতেই, যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদকারীরা এবং কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি আন্দোলনকারীরা ব্যাপক বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল, যা সহিংসভাবে দমন করা হয়েছিল।’

তবে, যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবিরোধীদের পাল্লা কমেই ভারি হচ্ছে, যেমন, ইরানে ইসরাইলের সর্বশেষ আক্রমণ সম্পর্কে ইলন মাস্ক সস্প্রতি এক্সস-এ বলেছেন, ‹আমাদের একে অপরের দিকে রকেট পাঠানো উচিত নয়, উচিত নক্ষত্রগুলির উদ্দেশ্যে পাঠানো।› তিনি বলেন, ‘বিশ্ব নেতারা একে অপরকে ইমেলে মেমস পাঠালেই পারেন এবং কে জিতবে, জনগণকে ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে দিন। আমি যুদ্ধের চেয়ে এটাই পছন্দ করি।›
বসন্ত ২০২৪ হার্ভার্ড ইয়ুথ পোল বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮-থেকে ২৯ বছর বয়সীরা মুদ্রাস্ফীতি এবং অভিবাসন সহ অন্যান্য প্রধান সমস্যাগুলিকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপ‚র্ণ হিসাবে মনে করে। জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মার্কিন তরুণ গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি সমর্থন করে।

বুধবার প্রকাশিত কুইনিপিয়াক ইউনিভার্সিটির জরিপ তেকে জানা গেছে যে, ৫৩ শতাংশ ডেমোক্র্যাট হামাসের সাথে যুদ্ধে ইসরায়েলের প্রচেষ্টার জন্য আরও সামরিক সহায়তা পাঠানোর বিরোধিতা করে। কিন্তু মনে হচ্ছে, ৮১ বঝর বয়সী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনে শিবিরে এমন সেকেলে ধারণা রয়েছে যে, দিন গড়ানোর সাথে সাথে প্রতিবাদকারীদের আবেগগুলি শেষ পর্যন্ত ¤øান হয়ে যাবে।

খুব সম্ভবত, বাইডেন শিবির আরও মনে করছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যখন নির্বাচনের কাছাকাছি পৌছে যাবে, এবং বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে প্রতিদ্ব›দ্বীতা আরও কঠোর হয়ে উঠবে, তখন ডেমোক্র্যাট-পন্থী ভোটাররা বাইডেনকে সমর্থন করবেন।

কিন্ত এটা একটা বেপরোয়া জুয়া খেলা। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, তারা একটি গণহত্যা প্রত্যক্ষ করছেন এবং একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যাকে তারা সমর্থন করেছিল সেটিতে মদদ যুগিয়েছে। তারা ব্যক্তিগতভাবে এমন একটি সঙ্ঘাতে জড়িত বোধ করেন, যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমইে উর্ধ্বমুখি হচ্ছে, যার কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না।

বহু মার্কিনীদের জন্য একটি নৈতিক তাড়না। তাই তাদের এই যুদ্ধবিরোধী অবস্থান সহজে পরিবর্তন করা যাবে না। লেখক: সাংবাদিক, কলঅমিসট ও সাহিত্যিক। সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য গার্ডিয়ান, এনবিসি নিউজ, শিকাগো ট্রিবিউন, এক্স।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের ঝুঁকি ও প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি

অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের ঝুঁকি ও প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি

ডিবি কার্যালয়ে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী

ডিবি কার্যালয়ে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী

লক্ষ্যটা নাগালেই রাখল বাংলাদেশ

লক্ষ্যটা নাগালেই রাখল বাংলাদেশ

ইসলামী শিক্ষা নিয়ে যে কোন দূরভিসন্ধি রুখে দিতে হবে পীর সাহেব চরমোনাই

ইসলামী শিক্ষা নিয়ে যে কোন দূরভিসন্ধি রুখে দিতে হবে পীর সাহেব চরমোনাই

জনসমর্থন না থাকায় বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকছে: কুষ্টিয়ায় হানিফ

জনসমর্থন না থাকায় বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকছে: কুষ্টিয়ায় হানিফ

উখিয়া ক্যাম্পে এক রোহিঙ্গা যুবককে জবাই করে হত্যা

উখিয়া ক্যাম্পে এক রোহিঙ্গা যুবককে জবাই করে হত্যা

ইসলামবিরোধী হিন্দুত্ববাদী কারিকুলাম প্রত্যাখ্যান করুন

ইসলামবিরোধী হিন্দুত্ববাদী কারিকুলাম প্রত্যাখ্যান করুন

শাহজালালে তিনদিন ৩ ঘণ্টা করে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ

শাহজালালে তিনদিন ৩ ঘণ্টা করে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ

মুস্তাফিজকে ছাড়াই চেন্নাইয়ের বড় জয়

মুস্তাফিজকে ছাড়াই চেন্নাইয়ের বড় জয়

সুদহার শিগগিরই বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে: গভর্নর

সুদহার শিগগিরই বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে: গভর্নর

মোদির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণায় এবার উপজীব্য ভোট জিহাদ, তারপর কী?

মোদির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণায় এবার উপজীব্য ভোট জিহাদ, তারপর কী?

‘বিশ্ব কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য দিবস ২০২৪’ পালন করলো এনার্জিপ্যাক

‘বিশ্ব কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য দিবস ২০২৪’ পালন করলো এনার্জিপ্যাক

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি. এর শরি‘আহ্ সুপারভাইজরি কমিটির ৪৪তম সভা অনুষ্ঠিত

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি. এর শরি‘আহ্ সুপারভাইজরি কমিটির ৪৪তম সভা অনুষ্ঠিত

দুই দিনে সোনার দাম বাড়ল ১৭৮৫ টাকা

দুই দিনে সোনার দাম বাড়ল ১৭৮৫ টাকা

এসআই পদে বয়সসীমা ৩০ করা হোক

এসআই পদে বয়সসীমা ৩০ করা হোক

ইউরোপীয় রাজনীতিতে শরণার্থী প্রসঙ্গ

ইউরোপীয় রাজনীতিতে শরণার্থী প্রসঙ্গ

হিন্দুত্ববাদের কবলে আমাদের পাঠ্যবই

হিন্দুত্ববাদের কবলে আমাদের পাঠ্যবই

রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব কী?

রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব কী?

দরকারী কাগজে নাপাকি লাগলে কী করণীয় প্রসঙ্গে।

দরকারী কাগজে নাপাকি লাগলে কী করণীয় প্রসঙ্গে।

প্রভাবিত হবে ইসরাইলের লোহা ইস্পাত পরিবহন ও ইলেকট্রনিক খাত

প্রভাবিত হবে ইসরাইলের লোহা ইস্পাত পরিবহন ও ইলেকট্রনিক খাত